শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০১:২১ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ চাই

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ চাই

এম এ খালেক:

বিষয়টি কষ্টকর তবে অপ্রত্যাশিত নয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ১০ শতাংশ কমেছে। শুধু বাংলাদেশেই যে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে তা নয়, বিশ্বব্যাপী একই চিত্র প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২১ প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০২০ সালে বিশ্ব বিনিয়োগ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, করোনা অতিমারির কারণে বিশ্বব্যাপী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে। আলোচ্য বছরে আগের বছরের তুলনায় বিনিয়োগ কমেছে ৩৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত এক দশকেরও বেশি সময় পর বৈশ্বিক বিনিয়োগ ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে তা গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

করোনা অতিমারির কারণে বিশ্বে বিনিয়োগ কমবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তা যে এতটা কমবে সেটি অনেকেই অনুমান করতে পারেননি। এমনিতেই বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে সব সময়ই অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে ছিল। উপরন্তু করোনার কারণে সেই বিনিয়োগ আরও কমে গেছে। দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান নেই-এটা অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন। অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত না হলে মুদ্রা পাচার কমবে না। এর অর্থ হচ্ছে, দেশে কার্যকর ও উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ বিদ্যমান নেই। দেশে যে বিনিয়োগ পরিবেশ নেই তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো তলানিতে। বছর দুই আগে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে দেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডার) নির্বাহী চেয়ারম্যান অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, ২ বছরের মধ্যে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ডাবল ডিজিটে অর্থাৎ ১০০-এর নিচে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি তার কথা বা অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেননি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারিত সময়ে ডাবল ডিজিটে আনা সম্ভব হবে না। তিনি ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি আগে অঙ্গীকার করে যে বাহ্বা নিয়েছিলেন তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি। আমাদের দেশে একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হলো আমরা অঙ্গীকার করি ব্যর্থ হওয়ার জন্য, তার দায়ভার গ্রহণের জন্য নয়। দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ কেন নেই, তার দায়ভার কে নেবে-এ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। ব্যবসায়-বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত না হলে বিদেশি কেন, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে না। বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তাই কেউ হুট করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। অনেক ভেবেচিন্তে মানুষ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

দেশে অনেক দিন ধরেই কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। কিন্তু এক ধরনের অনিশ্চয়তা, সংশয় বিদ্যমান রয়েছে। কোনো দেশে রাজনৈতিক সুস্থতা বিরাজমান না থাকলে কোনো বিনিয়োগকারীই সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারী তো বটেই, এমনকি স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করে। আর যে দেশে স্থানীয় বিনিয়োগ পর্যাপ্ত পরিমাণে হয় না, সেদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। কোনো দেশে বিনিয়োজিত পুঁজির সর্বোত্তম নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত মুনাফার সম্ভাবনা না দেখলে সেখানে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। কারণ অন্য দেশেও তার জন্য বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, যা একজন স্থানীয় বিনিয়োগকারীর সব সময় থাকে না।

আঙ্কটাডের বিনিয়োগ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ২০২০ সালে সরাসরি বিনিয়োগ কমে গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় কমেছে ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আগের বছর বিনিয়োগ কমেছিল ২০ শতাংশ। গত পঞ্জিকা বছরে দেশে ২৫৬ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ২১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ২৮৭ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য ২৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, যার পরিমাণ ছিল ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলার। অবশ্য এর পেছনে একটি বিশেষ কারণ কাজ করছিল, তা হলো সেই বছর জাপানি একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি কোম্পানি ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করেছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ জাপানি বিনিয়োগ আহরিত হয়েছিল। এ ঘটনা প্রতি বছর ঘটে না। ফলে সেই বছরের বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টি ছিল অনেকটাই অস্বাভাবিক একটি ঘটনা।

আঙ্কটাডের বিনিয়োগ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় কমেছে প্রতিটি দেশেই। রপ্তানি কমেছে বিপুল পরিমাণে। রপ্তানি কমার কারণে রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন এবং সেই খাতে বিনিয়োগও স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পেয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তৈরি পোশাক খাত। কিন্তু করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই তৈরি পোশাক খাতে সংকট দেখা দেয়। ২০২০ সালে করোনার প্রভাবে দেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার পরিমাণ তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। এর ফলে নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুসারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ করেছে কলম্বিয়া, যার পরিমাণ ৩৬৩ কোটি মার্কিন ডলার। এ তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইথিওপিয়া। তারা আহরণ করেছে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে মোজাম্বিক ও মিয়ানমার। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও এর পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ করেছে, তার মধ্যে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে পুনর্বিনিয়োগই বেশি। অর্থাৎ দেশে উৎপাদনরত কোম্পানিগুলো তাদের লভ্যাংশ নিজ দেশে না নিয়ে আবারও এখানেই বিনিয়োগ করেছে। বিনিয়োগ বোর্ড বা বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অর্থরিটি (বিডা) যে বিনিয়োগ পরিসংখ্যান প্রদর্শন করে, তাতে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ দেখানো হয়। স্থানীয়ভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরিসংখ্যান প্রদর্শন করে, তার মধ্যে বেশিরভাগই পরে অবাস্তবায়িত থেকে যায়। কাজেই সেগুলোকে সঠিক বিনিয়োগ চিত্র বলা যায় না। আঙ্কটাড যে বিনিয়োগ পরিসংখ্যান প্রদর্শন করে, তা ক্যাশ ট্রান্সফারের। কাজেই এটাকে প্রকৃত বিনিয়োগ চিত্র বলা যেতে পারে।

দেশে স্থানীয়ভাবে অনেক দিন ধরেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। স্থানীয় বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করার পেছনে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি-অনাচার, ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণ, বাজার স্থিতিশীল না থাকা ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। বাংলাদেশে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো অস্থিতিশীলতা নেই। তবে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে অনেক দিন ধরেই। সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক পেশিশক্তি দ্বারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এটা দেশে বিনিয়োগ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। কোনোভাবেই আমরা ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে পারছি না। আমরা কালো টাকার মালিকদের নানাভাবে প্রণোদনা দিচ্ছি, যা সৎভাবে উপার্জনকারীদের হতাশ করছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি না হলে দেশ-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আহরণ করা সম্ভব হবে না। দেশের অর্থনীতি এখন এক ধরনের পেশিশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সৎ ও দায়িত্বশীল উদ্যোক্তা এবং আর্থিক কর্ম সম্পাদনকারীরা এখন ক্রমশ পর্দার অন্তরালে চলে যাচ্ছেন। দুর্নীতিবাজ ও পেশিশক্তিধররা সর্বত্র গুরুত্ব পাচ্ছে। কালো টাকার মালিকদের মতো অপরাধীরাও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছেন, যতদিন দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ থাকবে, ততদিন তা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি জাতীয় সংসদের মতো স্থানে দাঁড়িয়ে বলেছেন, মুদ্রা পাচারকারীদের তালিকা দিন, আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রশ্ন হলো, মুদ্রা পাচারকারীদের তালিকা কে দেবে? অর্থমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় যদি মুদ্রা পাচারকারীদের না চেনেন, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? মুদ্রা পাচারকারীদের জাতীয় শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। অপ্রদর্শিত অর্থ যে প্রক্রিয়ায় সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে সৎভাবে অর্থ উপার্জনকারীদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশেই সৎভাবে উপার্জনকারীদের চেয়ে কম ট্যাক্স দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয় না। অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে প্রচলিত হারে কর প্রদানের পর নির্দিষ্ট হারে জরিমানা আদায়পূর্বক তা করা যেতে পারে। কোনো দেশের অর্থনীতি যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সেদেশে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্মরণকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করি এটা কেন হচ্ছে? যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে, তা ব্যয় করতে না পারার কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ এবং স্ফীত রিজার্ভ একটি দেশের জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থার নির্দেশক। এমনকি প্রচুর বিনিয়োগ এবং সীমিত পরিমাণে রিজার্ভও কাম্য হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই বিনিয়োগবিহীন স্ফীত রিজার্ভ কাম্য হতে পারে না। এটা অর্থনীতির স্থবিরতারই লক্ষণ। আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা না গেলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না প্রত্যাশামতো। আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি কি এভাবেই চলবে, নাকি এ থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

এম এ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877